রাজনৈতিক কাঠামো ও নাগরিক দায়িত্ব

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান - History & Social Science - | NCTB BOOK
61
61

রাজনৈতিক কাঠামো ও নাগরিক দায়িত্ব

মানুষ সামাজিক জীব। আমরা সবাই কোনো না কোনো সমাজে বাস করি। সমাজের একটি গুরুত্বপর্ণ প্রাথমিক কাঠামো হলো পরিবার। মূলত আমাদের এই সামাজিক জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যই গড়ে উঠেছে পরিবার। তাহলে দেখো সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সকল কাঠামো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আছে আলাদা আলাদা ব্যক্তি এবং তাদের আলাদা আলাদা ভূমিকা। এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলো বিশ্লেষণ করে এসব ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ও ভূমিকা নির্ধারণ করব। সেই লক্ষ্যে পুরো শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা কিছু একক ও দলীয় কাজ করব।

স্থানীয়ভাবে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান

আমরা তো জানি, বিদ্যালয় স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক কাঠামো এবং ইউনিয়ন পরিষদ/সিটি কর্পোরেশন একটি রাজনৈতিক কাঠামো। আমাদের প্রত্যেকের পরিবারে সকল কাজ শৃঙ্খলার মাধ্যমে করার জন্য পরিবারের সকল সদস্যকে আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে তাই না! তেমনই আমাদের এলাকা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্যও কিছু মানুষ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমরা এখন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতি অনুসরণ করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে ও ইউনিয়ন পরিষদ/সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির থেকে বিদ্যালয়ের এবং স্থানীয় সরকার পরিচালনা ও কার্যক্রম সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করব। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতি সম্পর্কে তো আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। যদি আবারও জেনে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে প্রথম শিখন অভিজ্ঞতাটি আরেকবার ভালোভাবে দেখে নেব।

  • কাজটি করার জন্য আমরা ২টি পৃথক প্রশ্নমালা তৈরি করে ইউনিয়ন পরিষদ / সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে স্থানীয় সরকার পরিচালনা এবং বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করব। কাজটি আমরা ৫-৬ জনের দলে ভাগ হয়ে করব।
  • নিচে দেওয়া নমুনা প্রশ্নমালা ব্যবহার করে আমরা আমাদের অনুসন্ধানের জন্য দুটি প্রশ্নমালা তৈরি করে নেব।

 নমুনা প্রশ্নমালা

বিদ্যালয়ের কাঠামো ও কার্যক্রম- সম্পর্কিত অনুসন্ধান 

প্রশ্নমালা

১. বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা হয়? 

২. বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে কারা কারা যুক্ত আছেন? 

৩. কীভাবে এসব দায়িত্ব বণ্টন করা হয়? 

৪. একাডেমিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কী কী যুক্ত হলে আরো ভালো হতো বলে আপনি মনে করেন?

৫. . . . . . . . . . . . . . . . .

৬. . . . . . . . . . . . . . . . . 

৭. . . . . . . . . . . . . . . .. . 

ইউনিয়ন পরিষদ/ সিটি কর্পোরেশন কাঠামো ও কার্যক্রম সম্পর্কিত অনুসন্ধান 

প্রশ্নমালা

১. ইউনিয়ন পরিষদ/ সিটি কর্পোরেশন সরকার কাঠামোর কোন স্তরে আছে? 

২. এখানে দায়িত্বগুলো কে/ কারা বন্টন করেন? 

৩. মূল কাজগুলো কী কী? 

৪. আর কোন কোন কার্যক্রম এখানে যুক্ত হলে ভালো হতো বলে আপনি মনে করেন?

৫. . . .. . . . . . . . . .. . . . . . . . . . . 

৬. . . . . . .. . . . . . . . . . . . . . . . .. .

৭. . . . . .. . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . 

 .

  • অনুসন্ধান হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদে যেসব সেবা পাওয়া যায় সেসব ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা চিহ্নিত করে নিচে দেওয়া ছক ব্যবহার করে পোস্টার পেপারে উপস্থাপন করব। পোস্টার পেপার হিসেবে আমরা পুরোনো ক্যালেন্ডার বা কাগজের প্যাকেট ব্যবহার করতে পারি।

স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ

আমরা তো স্থানীয়ভাবে বিদ্যমান একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে জানলাম। নিশ্চয়ই এছাড়া আরো অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে আছে তাই না! চলো তাহলে আমরা যা জানি এবং পাঠ্যবইয়ে বিদ্যমান তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলো বিশ্লেষণ করে নিজ নিজ অবস্থান শনাক্ত করি, পরে আমাদের কী কী ভূমিকা থাকতে পারে তা দলীয়ভাবে আলোচনা করে উপস্থাপন করি।

  • নিচে দেওয়া ছক ব্যবহার করে আমরা তালিকা তৈরির কাজটি করতে পারি।
বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোযে ধরনের সেবা পাওয়া যায়আমার ভূমিকা

বিদ্যালয়

 

শিক্ষার্থীবিদ্যালয়ের নিয়মকানুন মেনে চলা, পরিচ্ছন্নতায় সহযোগিতা করা..…………

 

 

  

 

 

  

 

 

  

 

বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোআমার অবস্থানআমার ভূমিকা

 

ইউনিয়ন/ সিটি কর্পোরেশন

নাগরিক

এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা প্রদান

 

 

  

 

 

  

 

 

  

বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদগুলোর তুলনামূলক যৌক্তিক বিশ্লেষণ করে নিজের অবস্থান নির্ধারণ

বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। চলো আমরা এখন সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জেনে আসি। কাজটি করার জন্য আমরা আমাদের পাঠ্যবইয়ে উল্লেখিত রাজনৈতিক কাঠামো ও নাগরিক দায়িত্ব (অনুসন্ধানী অংশ) এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: রাজনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে এই শিখন অভিজ্ঞতা দুটি ভালোভাবে পড়ব। এরপর পাঠ্যবই ও অন্যান্য উৎস হতে বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদগুলো দলীয়ভাবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে আমার অবস্থান চিহ্নিত করব এবং অবস্থানের পক্ষে যৌক্তিক বিশ্লেষণ করব।

বিশ্লেষণ হতে প্রাপ্ত তথ্য আমরা নিচে দেওয়া ছক অনুসরণ করে উপস্থাপন করবে।

বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান রাজনৈতিক মতবাদসমূহআমার অবস্থানসপক্ষে যুক্তি

 

 

  
 

 

 

 
 

 

 

 

স্থানীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলে এমন কিছু কাজের তালিকা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

আমরা এই শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্থানীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো - এবং এসব কাঠামোতে আমাদের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে জানলাম। এপর্যায়ে আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে - সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের সদস্য নির্বাচন করে নবম শ্রেণির জন্য সক্রিয় নাগরিক ক্লাব গঠন করব। = সক্রিয় নাগরিক ক্লাব গঠন করে এই ক্লাবের একটি কার্যক্রম হিসেবে নিজ এলাকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আলোকে কিছু কাজ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করব যা স্থানীয় কাঠামোগুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিক কাঠামোতেও প্রভাব ফেলবে।

প্রথমে আমরা স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো- এর আলোকে আমাদের যে যে ভূমিকা চিহ্নিত করেছিলাম তার মধ্যে ১/২ টি কাজ আমাদের এলাকার সাপেক্ষে নির্ধারণ করে আমাদের নবগঠিত সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করব। কাজটি করার জন্য আমরা শিক্ষক ও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা নেব।

কাজের তালিকা

 

 

 

 

 

 

 

রাজনৈতিক কাঠামো ও নাগরিক দায়িত্ব (অনুসন্ধানী অংশ)

আজ শ্রেণিকক্ষে এসে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের স্যার একটু যেন উদাস হয়ে আছেন। তাঁর এ মনোভাব দেখে সবাই একটু অবাকই হয়ে গেল। সীমা চুপ থাকার মেয়ে নয়, বলল- স্যার, আপনার কি মন খারাপ? স্যার কিছু না বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটু নাড়াচাড়া করে বললেন, শোনো-

হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব; 

ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ। স্যার থামতেই ওরা হাত তালি দিল এবং সবার হয়ে সুলতানা বলল, চমৎকার একটা গান শোনালেন (বা কবিতা শোনালেন) স্যার আমরা কি পুরো গানটা শুনতে পারি? স্যার বললেন, তার আগে একটা কাজ করি চলো। এবার সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, কী কাজ স্যার?

স্যার বললেন, গানের কথাগুলো খেয়াল করো আরেকবার। এবার তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, পৃথিবীটা যেন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে আছে, প্রতিদিনই নানা জায়গায় নিষ্ঠুর যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। চলার পথ যেন অন্ধকার এবং কুটিল, পদে পদে লোভের প্রতিবন্ধক। এ সকল যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ন্য ভূমিকা পালন করে তার নাম কি তোমরা বলতে পারো। সবাই সমস্বরে বলল জাতিসংঘ। তাহলে চলো, সবাই মিলে জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি ও কার্যক্রম সম্পর্কে জানি।

জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি

যুদ্ধ কখনো শান্তির বাহক হতে পারে না। যুদ্ধ আনে ধ্বংস, দুর্ভোগ এবং অশান্তি। বিশ্বজুড়ে হাহাকার, নিপীড়ন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এবং প্রায় মাঝামাঝি সময়ে দুটো বিশ্বযুদ্ধ আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে অনেকটাই নিঃস্ব করে গেছে। এর একটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) এবং অন্যটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫)। পৃথিবীব্যাপী জাতিগত দ্বন্দ্ব মেটানোর উদ্দেশ্যে শান্তির মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা কিছু মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে চুপ করে বসে থাকেননি। সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টায় অবিচল ছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর পরই ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি গোটা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'লিগ অব নেশনস' গঠিত হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে 'লিগ অব নেশনস' প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আরেকটা যুদ্ধ এসে কড়া নাড়া শুরু করল। ১৯৩৯ সালে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ছয় কোটি মানুষ প্রাণ হারান; পঙ্গু ও আহত হন বহু লক্ষ মানুষ। অনেকেই ঘরহারা হন। কেউ কেউ পঙ্গুত্বকে আজীবনের সঙ্গী করেন।

বহু দেশ যুদ্ধে তাদের কর্মক্ষম যুবকদের হারিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছে। তোমরা জানো এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ছোট্ট দুটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলেছিল। তাতে মুহূর্তের মধ্যে হিরোশিমায় ৬৬ হাজার মানুষ ও নাগাসাকিতে ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আর আণবিক তেজস্ক্রিয়তায় আহত হয়ে দীর্ঘ পঙ্গু জীবন কাটিয়ে আরও প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সেদিন দুটি নগরীই তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধ

এ যুদ্ধ শুরু হয় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বর্তমান বসনিয়া-হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যর (আধুনিক অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি) যুবরাজ ফারডিনাগুকে সার্বীয় জাতীয়তাবাদীরা গুলি করে হত্যা করলে যুদ্ধের সূচনা হয়। হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ২৮ জুন ১৯১৪ সালে। যে পক্ষ আক্রমণ করেছিল তাদের বলা হয় অক্ষ শক্তি বা কেন্দ্রীয় শক্তি। এই পক্ষে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও তুরস্ক। অপর পক্ষকে বলা হয় মিত্রশক্তি। এই পক্ষে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, বেলজিয়াম, সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো ও জাপান। অক্ষশক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান হয় ১৯১৮ সালে। এই চার বছরের যুদ্ধে ইউরোপের আরও দেশ জড়িয়ে পড়েছিল এবং রণাঙ্গন ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। এ যুদ্ধে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারান এবং দ্বিগুণ মানুষ আহত হন। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জার্মানি ও তুরস্কের শক্তি খর্ব হয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ

বলা হয় প্রথম মহাযুদ্ধ অবসানে যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল (বিশেষত ভার্সাই চুক্তি) তার মধ্যেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। এই চুক্তি জার্মানির জন্য অবমাননা ও গ্লানিকর ছিল। ফলে মাত্র পনেরো বছরের মধ্যে সেখানে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী নাৎসি পার্টি ক্ষমতাসীন হয়। তারপর থেকেই শুরু হয় জার্মানির শক্তি সঞ্চয় ও বড়ো রকম যুদ্ধের প্রস্তুতি। পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর। এবারেও উভয় পক্ষে শক্তি সমাবেশ ঘটতে থাকে। জার্মানির নেতৃত্বে গঠিত অক্ষশক্তিতে ছিল ইতালি ও জাপান। মিত্রশক্তি হিসেবে ছিল ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম ধাক্কায় জার্মানি একে একে ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড, হল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং ফ্রান্স দখল করে। তারা পূর্ব দিকেও বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছে। আক্রান্ত রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন স্ট্যালিনের নেতৃত্বে জার্মানির আক্রমণ রুখে দেয় এবং পাল্টা অভিযান শুরু করে। এই যুদ্ধে চার্চিলের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডও প্রবল মনোবল দেখিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে সফল হতে থাকে।

এ যুদ্ধ একদিকে মারণাস্ত্রের ক্ষমতা ও সংখ্যা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে আফ্রিকা ও এশিয়ায় স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভবের পথ তৈরি করেছিল। যুদ্ধে ব্যাপক হারে তরুণদের মৃত্যু হওয়ায় বিধ্বস্ত ইউরোপে নারীদের কর্মজগতে প্রবেশের বাস্তবতা তৈরি হয়। এতে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হয়। তবে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় তাদেরকে ঘিরে নতুন দুটি বলয় তৈরি হয়ে পুনরায় বিভাজন ও উত্তেজনা তৈরি করে। একে বলা হয় স্নায়ুযুদ্ধের (cold war) কাল। সরাসরি দুই পক্ষে যুদ্ধ না হলেও অস্ত্র প্রতিযোগিতা, অস্ত্রসজ্জা ও উত্তেজনা চলতেই থাকে। বিশ্বের নানা স্থানে সশস্ত্র সংঘাতও কখনো থামেনি।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের পরে তাই বলেছিলেন- যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয় (The war is won but not peace)

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব বিবেককে যেন নির্বাকও করে তোলে। তবে কেউ কেউ পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীতা অনুভব করেন। এই প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই তৎকালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশ্ব উত্তেজনা কমাতে অনেকগুলো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক চার্টার (Atlantic Charter)-এ স্বাক্ষর করেন। এ সনদে বিশ্বের সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা, স্থায়ী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আক্রমণকারীদের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছিল। এসব আদর্শের উপর ভিত্তি করেই পরে জাতিসংঘ সনদ রচিত হয়। তবে জাতিসংঘ নামটি এসেছে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিল, সেই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে । এ চারটি দেশ এক ঘোষণাপত্রে আটলান্টিক চার্টারে বর্ণিত নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিল যা 'United Nations Declaration' বা জাতিসংঘ ঘোষণা নামে পরিচিত। পরে ২ জানুয়ারি আরো ২২টি রাষ্ট্র এ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানায়। জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট হিসেবে মস্কো ঘোষণা, তেহরান সম্মেলন, ডুম্বারটন ওকস সম্মেলন ও ইয়াল্টা সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মস্কোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন, যা মস্কো ঘোষণা বা 'Moscow Declaration' নামে পরিচিতি। মস্কো ঘোষণায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল যে, 'এ সংস্থা সকল শান্তিপ্রিয় দেশের সার্বভৌমত্ব ও সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।' বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ছোটো বড়ো শান্তিপ্রিয় সব দেশের জন্য এ সংগঠনের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকবে।

১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে তেহরানে বিশ্ব রাজনীতির তিন শীর্ষ নেতা, রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), স্ট্যালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন) ও চার্চিল (ব্রিটেন) অপর এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা জানান যে, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগদানের জন্য বিশ্বের সকল ছোটো ও বড়ো দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তাঁরা আরও জানিয়েছিলেন যে, বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তাঁদের উদ্যোগ সফল হবে। এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সকল জাতি যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। যে আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার রূপরেখা প্রণীত ও গৃহীত হয় ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে ওয়াশিংটনের ডুম্বারটন ওকস সম্মেলনে। প্রথম পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৪৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এবং তা চলে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। সম্মেলনে একটি বিশ্ব সংস্থা গঠন ও এর কাঠামো সম্পর্কে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সম্মেলনে বিশ্বসংস্থার নামকরণ করা হয় 'সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ' বা জাতিসংঘ। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে বিশ্ব সংস্থার চারটি শাখা থাকবে সকল সদস্যরাষ্ট্র নিয়ে সাধারণ সভা, ১১ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয় ও একটি সচিবালয়। নিরাপত্তা পরিষদ গঠনে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যের প্রস্তাব করা হয়। বলা হয় পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য এবং ছয়টি দেশ অস্থায়ী সদস্যপদ পাবে। অস্থায়ী সদস্যপদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল দুইবছর পরপর সাধারণ সভা কর্তৃক এরা নির্বাচিত হবে। ডুম্বারটন ওকস পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়াল্টায় একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেন রুজভেল্ট, স্ট্যালিন ও চার্চিল। ওই সম্মেলনে বৃহৎ পাঁচটি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্সকে ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাঁরা এমন সিদ্ধান্ত দেন যে, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে দ্রুত প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক সংস্থাটি গঠন করা হবে। ইয়াল্টা শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি সনদ রচনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ - জুন পর্যন্ত ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। ২৬ জুন ১১১টি ধারা সংবলিত সনদটি অনুমোদিত হয়। তাতে বৃহৎ পঞ্চশক্তির ভেটো ক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। তবে সর্বসম্মতভাবে সনদটি স্বাক্ষরিত হয় সে বছর ২৪ অক্টোবর। মোট ৫১টি দেশ মূল সনদে স্বাক্ষর করেছিল। তাই আমরা প্রতিবছর ২৪ অক্টোবর 'জাতিসংঘ দিবস' পালন করি। সারা বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা 'জাতিসংঘ'-এর সদস্য। বর্তমানে ১৯৩টি দেশ জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র। আরো দুইটি দেশ পর্যবেক্ষক দেশের তালিকায় রয়েছে। দেশগুলো হলো ভ্যাটিকান সিটি ও ফিলিস্তিন। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। জেনেভা, ভিয়েনা ও নাইজেরিয়াতে এর শাখা অফিস রয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের ১ নম্বর ধারায় চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

১. আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা; 

২. প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে সাম্যের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা; 

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা; এবং 

৪. উপরে উল্লিখিত উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই আন্তর্জাতিক সংগঠনকে সকল জাতির ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।

জাতিসংঘ সনদের ২ নম্বর ধারায় সাতটি মৌলিক নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১ নম্বর ধারায় যেসব উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য এ নীতিমালাগুলো অপরিহার্য। জাতিসংঘ সনদে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রতিটি দেশ এই সাতটি মৌলিক নীতিকে সামনে রেখেই তাদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনা করবে। এই সাতটি নীতি হচ্ছে-

ক) প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সমতা নীতির উপর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত; 

খ) প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অধিকারের ব্যাপারে জাতিসংঘ সনদে যে বিধান ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, তা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে; 

গ) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র লক্ষ্য রাখবে, সদস্যরাষ্ট্রগুলো অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এমন কিছু করবে না, যাতে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়; 

ঘ) প্রতিটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; 

ঙ) জাতিসংঘ গৃহীত প্রতিটি সিদ্ধান্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলো সমর্থন করবে; 

চ) জাতিসংঘ সদস্য নয় এমন দেশ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে যাতে এই নীতিগুলো অনুসরণ করে জাতিসংঘ সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে; 

ছ) জাতিসংঘ কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু শান্তি ও নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয়, তাহলে জাতিসংঘ ঐদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

জাতিসংঘের অঙ্গ বা শাখাসমূহ 

সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের ছয়টি শাখা আছে। শাখাগুলো হচ্ছে-

                      

বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ

বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য। তাই আমাদের দেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশ ১৯৭৯-৮০ সালের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে দ্বায়িত্ব পালন করে। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের কার্যপ্রণালিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয়। ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪২তম অধিবেশনে হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতিত্ব করেন।

বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন আবাসিক ও অনাবাসিক সংস্থাগুলো এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। বাংলাদেশে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (MDG) পর ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে সহায়তা প্রদান বা সহায়ক ভূমিকা পালন এই সংস্থা গুলোর প্রধান লক্ষ্য।

বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি মুক্তির আন্দোলন নয়, এটি অন্যায়ভাবে শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এবং মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘ প্রথমত যুক্ত হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রকাশ করার জন্য।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা চেয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ-থান্টের কাছে। সে সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ঢাকাস্থ প্রতিনিধির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন তাঁরা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের উপর যে গণহত্যা সংঘটিত হয়, তা সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অন্যান্য বিশ্বনেতার সঙ্গে সেদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ-থান্ট এই গণহত্যাকে নিন্দা জানিয়ে একে 'মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়' বলে অভিহিত করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সরকার গঠনের পর এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বের জনমত ও রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায় করা। এ উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকারের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদলকে ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘ প্লাজায় একটি সাংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে আপস সম্ভাবনার পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বক্তব্য নিরাপত্তা পরিষদের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রথম জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়।

শরণার্থীদের সহায়তাদান

দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রটিতে জাতিসংঘ সক্রিয় ছিল, সেটা হচ্ছে শরণার্থীদের সাহায্য প্রদান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমানবিক অত্যাচার ও গণহত্যার কারণে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। এই শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে ব্যবস্থাপনা ও অর্থের প্রয়োজন ছিল, তা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে মেটানো সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকালে ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তার কাজে জাতিসংঘের এই সম্পৃক্তির ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কৌশলগতভাবে লাভবান হয়। পাকিস্তান এবং আরো কিছু দেশ এ যুদ্ধকে পাকিস্তানের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়' এবং ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব বলে চিত্রিত করার যে অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল, জাতিসংঘের এ সাহায্যের ফলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী-সংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানসহ উচ্চপদস্থ জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ইউএনএইচসিআর ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউনিসেফ প্রভৃতি জাতিসংঘ সংস্থা শরণার্থীদের জন্য কাজ শুরু করে।

১৯৭১ সালের জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে প্যারিসে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের যে বৈঠক হয়, তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত নতুন সাহায্য দিতে দাতাগোষ্ঠী অস্বীকার করে। 'পূর্ব পাকিস্তান কার্যত সরকারবিহীন রয়েছে'- বিশ্বব্যাংকের এ মন্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) আলোচ্যসূচিতেও বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা গুরুত্বপূর্ণভাবে উত্থাপিত হয়।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ বৃহৎ আকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়। ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম জাতিসংঘ রিলিফ অপারেশন ঢাকা (আনরড) নামে পরিচিত। ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন এবং আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্যার রবার্ট জ্যাকসনের পরিচালনায় শুরু হয় এই ত্রাণ কাজ। এই কার্যক্রমের ব্যাপ্তির ফলে আনরডের নাম কিছু দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে পরিণত হল আনরব (UNRB)-এ, যার পুরো নাম বাংলাদেশ জাতিসংঘ ত্রাণ কার্যক্রম।

মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর

বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্ক আরো জোরদার হয় যখন ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয় নেতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সফর দ্বারা জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। তখন জাতিসংঘের সহায়তায় যুদ্ধকালীন বিধ্বস্ত চালনা পোর্টে ডুবে যাওয়া জাহাজগুলো অপসারণ করা হয়। এছাড়া ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানে আটকা পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনতেও জাতিসংঘ উদ্যোগ গ্রহণ করে।

জাতিসংঘের যেসব সংস্থা বাংলাদেশে কাজ করছে

UNDP

UNDP: (United Nations Development Programme) উন্নয়ন কর্মসূচি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি সহায়ক সংস্থা। ১৯৬৫ সালের ২২ নভেম্বর এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইউএনডিপি দেশব্যাপী অসংখ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ইউএনডিপির সহায়তায় সহস্রাব্দ উন্নয়নের (MDG) আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন, দারিদ্র্য হার হ্রাস এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDG) অর্জনে বিশেষ করে শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে অবদানের জন্য জাতিসংঘের এওয়ার্ড লাভ করেন। বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনের লক্ষ্যে কাজ চলছে।

UNICEF

UNICEF: (United Nations Chidren's Fund) জাতিসংঘ শিশু তহবিল। ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অগণিত শিশু অনাথ হয়েছিল। এই শিশুদের সাহায্যের জন্য একটি তহবিল তৈরি করার সিদ্ধান্ত থেকেই এই সংস্থা।

আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউনিসেফ কাজ করছে।

UNESCO

UNESCO: (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization) জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর লন্ডন সম্মেলনে ১৬ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৬ সালে এই সংস্থাটি জাতিসংঘের সহায়ক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসার ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো জাতিসংঘের এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য।

FAO

FAO: (Food & Agriculture Organization) জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর সদর দপ্তর ইটালির রোমে।

বাংলাদেশের বিশাল বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।

WHO

WHO: (World Health Organization) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে এর সদর দপ্তর অবস্থিত।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে।

UNHCR

UNHCR: (United Nations High Commission for Refugees) উদ্বাস্তু বিষয়ক জাতিসংঘ হাই কমিশনারের কার্যালয় বা ইউএনএইচসিআর। এটি ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দুইবার, ১৯৫৪ এবং ১৯৮১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার ইস্যুতে এই কার্যালয় মধ্যস্থতা করছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দৈনন্দিন খরচ মেটানোর ক্ষেত্রেও বড়ো অবদান রাখছে এই সংস্থা। এছাড়া বাংলাদেশে বিহারি জনগোষ্ঠীর আবাসনসহ অন্যান্য ইস্যুতে এই সংস্থা ব্যাপক অবদান রেখেছে।

UNIFEM

UNIFEM: (United Nations Development Fund for Women) জাতিসংঘ নারী উন্নয়ন তহবিল বা ইউনিফেম। জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থা। বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নে এ সংস্থাটি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে।

নারীদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা রাখছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ত করছে। নারীদের নিরাপদ শ্রম অভিবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও এ সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে।

UNFPA

UNFPA: (United Nations Population Fund) জাতিসংঘের জনসংখ্যা কার্যক্রম তহবিল বা ইউএনএফপিএ এর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কৌশল এবং প্রোটোকল তৈরি করা, জন্মনিয়ন্ত্রণে সচেতন করা এবং বাল্যবিবাহ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ, প্রসূতি মাতাদের যত্ন ইত্যাদি।

সংস্থাটি বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ILO

 ILO: (International Labour Organization) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। শ্রমিক- কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে উন্নতি ও তাদের সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধান করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা। সংক্ষেপে আইএলও (ILO) নামে পরিচিত। ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী ১৯১৯ সালের ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য সর্বজনীন ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্য অর্জনে সংস্থাটি কাজ করে চলেছে। এর সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত।

মূলত শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, স্বচ্ছন্দ জীবনের উপযোগী মজুরি ও স্বাস্থ্যসম্মত মানবিক কর্মপরিবেশের মতো অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের বিভিন্ন রকম সমস্যা সমাধান ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখার প্রতিও এ সংস্থা নজর রাখে। ফলে ILO জাতিসংঘের প্রথম বিশেষ সংস্থা হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

উপরোক্ত সংস্থাগুলো ছাড়াও জাতিসংঘের আরও অনেকগুলো উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে।

এরপরে একদিন ক্লাসে এসে স্যার বললেন, খেয়াল করেছ, বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে আমরা কিন্তু বারবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসেছি। চলো, আমরা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শান্তি, নিরাপত্তা উন্নয়নের জন্য যেভাবে কাজ হয়, তার মতোই স্থানীয় পর্যায়ের কাজ সম্পর্কেও জানব।

শিক্ষার্থীরা সবাই উৎসাহের সঙ্গে লাফিয়ে ওঠে তাঁকে সমর্থন জানাল। তখন স্যার এ বিষয়ে তাদের বিস্তারিতভাবে জানালেন।

আমরা সকলেই জানি প্রতি দুই বছর পরপর আমাদের স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচন হয়। এতে একজন সভাপতি ও কয়েকজন অভিভাবক সদস্য নির্বাচিত হন। প্রধান শিক্ষক মহোদয় পদাধিকার বলে সদস্য সচিব এবং দুই বা ততোধিক শিক্ষক প্রতিনিধি শিক্ষকদের ভোটে নির্বাচিত হন। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি যেমন স্কুলে পড়ালেখার মান উন্নয়ন এবং স্কুলের সার্বিক উন্নতির জন্য কাজ করেন, সব সময় খোঁজখবর নেন, তেমনি আমাদের এলাকার উন্নয়ন, সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সিটি কর্পোরেশন/পৌর সভা/ ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। আমরা একজন কাউন্সিলর/পৌর মেয়র/ইউপি চেয়ারম্যান বা মেম্বারের কাছ থেকে স্থানীয় সরকার পরিচালনার কাঠামো ও কার্যক্রম সম্পর্কে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করব।

সিটি কর্পোরেশন এলাকার একটা স্কুলের ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় রেখে ৫/৬ জন করে শিক্ষার্থী নিয়ে কয়েকটি দলে ভাগ করে দিলেন। আসিরের নেতৃত্বে একটি দল এলাকার কাউন্সিলর সাহেবের কাছে গেল।

তাঁর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সানা জানতে চাইলো স্থানীয় সরকার কী?

দেশের প্রান্তিক স্তরের বা তৃণমূল পর্যায়ের শাসন ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ গোপন ভোটে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থাকে স্থানীয় সরকার বলে। এলাকার স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ সরকার গঠিত হয়। স্থানীয় সরকার স্থানীয় পর্যায়ের নাগরিকদের যথাযথভাবে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন সেবা প্রদান করতে পারে।

আমাদের দেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ে রয়েছে জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে উপজেলা পরিষদ এবং গ্রাম পর্যায়ে সাধারণত কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়াও ছোটো ছোটো শহর এলাকায় পৌরসভা (যেমন: নাঙ্গলকোট, হাটহাজারী, লামা, কুতুবদিয়া ইত্যাদি) এবং বড়ো বড়ো শহরগুলোতে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ইত্যাদি)। এগুলো স্থানীয় সরকারের অংশ। আমরা জানি বাংলাদেশে তিনটি পার্বত্য জেলায় জেলা পরিষদের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থানীয় সরকার পরিষদও রয়েছে।

শোভন জানতে চাইল, স্থানীয় সরকার পরিষদের কাঠামো তাহলে আমরা কীভাবে ভাবতে পারি?

কাউন্সিলর সাহেব একটা কাঠামো তাদের দেখালেন। স্থানীয় সরকার পরিচালনার কাঠামোটি নিম্নরূপ-

উপরের ছকে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিন্যাস দেখানো হয়েছে।

আমরা জানি, আমাদের এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আয়তনে বেশি বড়ো না হলেও লোকসংখ্যা অনেক বেশি। তাই কেন্দ্রে থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রের প্রান্তিক অঞ্চলের ছোটো-বড়ো বহু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। তা বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের ছোটোখাটো সমস্যার সমাধান সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এতে দুটো লাভ ক) কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ কমে এবং খ) স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাগুলোরও সুষ্ঠু সমাধান হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় শাসনব্যবস্থা অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দিন দিন স্থানীয় সরকার কাঠামো জনগণের কাছে পরিচিত ও বিকশিত হয়ে উঠছে।

ক) ইউনিয়ন পরিষদের কাঠামো: আমরা প্রথমেই ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের ইতিহাস সম্পর্কে জানব। এটি আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশপূর্ব আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, গ্রাম এলাকায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটি কাজ করছে। ব্রিটিশ আমলে গ্রাম এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করার জন্য চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ১৮৭০ প্রবর্তিত হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনার জন্য এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৮৮৫ সালে স্থানীয় পর্যায়ে অধিক দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গীয় স্থানীয় আইন পাস হয়। এই আইনে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা পর্যায়ে মহকুমা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯১৯ সালের পল্লি আইনে চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন বোর্ড নামে একটি মাত্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় ইউনিয়ন কাউন্সিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ- এই তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধিত আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।

আমরা জানি, ইউনিয়ন পরিষদ হলো স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর বা প্রাথমিক স্তর। কয়েকটি গ্রামের সমন্বয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে চার হাজার পাঁচশ একাত্তরটি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় সরকার হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এর মূল লক্ষ্য হলো গ্রামের মানুষের সেবা প্রদান এবং গ্রামীণ সমস্যার সমাধান ও তৃণমূলের মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ইউনিয়ন পরিষদের কাঠামোতে রয়েছেন-

ইউনিয়ন পরিষদের কাজঃ

এলাকার উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ অনেক দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে কিছু মুখ্য কাজ ও কিছু ঐচ্ছিক কাজ রয়েছে। যেমন:

ক) শৃঙ্খলা রক্ষা: ইউনিয়ন পরিষদের প্রধান কাজ হলো গ্রামের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব পালনের জন্য

  •  প্রতিটি ইউনিয়নে কিছুসংখ্যক চৌকিদার ও দফাদার নিয়োগ করা; 
  •  বিশৃঙ্খলা ও চোরাচালান বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ; 
  •  ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিরসনে ভূমিকা পালন; 
  • গ্রাম আদালত সম্পর্কিত দায়িত্ব সম্পাদন; 
  • পারিবারিক বিরোধের আপস-মীমাংসা;

খ) কাজ ও সেবা: এক কথায় এ সংস্থার মূল কাজ হলো সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে ইউনিয়নে অবস্থিত কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থার সেবা ও কার্যক্রম জনগণকে অবহিতকরণ। এর প্রধান কাজগুলো হলো-

• গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্থার কর্মসূচির অধীনে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; 

• দারিদ্র্য বিমোচন; 

• স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন; 

• আত্ম-কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম 

• এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কাজ তো রয়েছেই।

গ) অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন: এলাকার কৃষি উন্নয়নের জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। যেমন-

 

• গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন সাধন; 

• বাজার সৃষ্টি; 

• মৎস্য চাষ ও পশু পালনের উন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিতকরণ; 

• উন্নত বীজ, চারা ও সার বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা; 

• জনগণের আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে পরামর্শ প্রদান; 

• কর্মসংস্থান সৃষ্টি; 

• বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি কাজ।

 

এ ছাড়া রয়েছে ঐচ্ছিক কাজ:

• এলাকার রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ; 

• এতিম, দুস্থ, গরিব ও বিধবাদের সাহায্য করা; 

• প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা; 

• সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত ও তদারকি করা; 

• এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ করা; 

• ইউনিয়নকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা; 

• দুস্থ ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন; 

• সকল প্রকার শুমারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন; 

• সরকারি সম্পত্তি যেমন: সড়ক, সেতু, খাল, বাঁধ, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ; 

• প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা প্রদান এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা: 

• চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি; 

• জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি; 

• জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপাদানগুলো সহজলভ্য ও সরবরাহ নিশ্চিত করা; 

• অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান: 

• বয়স্কদের অক্ষরজ্ঞানদান ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা; 

• এলাকার মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ; 

• এলাকার জমির খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা এবং খাজনা প্রদানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা; 

• এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বা অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা; 

• বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন: ইভ টিজিং, যৌতুক প্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ; 

• এলাকার শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সভা-সমাবেশের আয়োজন: 

• প্রতিটি গ্রামে শিক্ষা চর্চার উদ্দেশ্যে পাঠাগার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ; 

• রোগব্যাধি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জনগণকে টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা; 

• বর্ষার মৌসুমে গাছের চারা লাগানোর জন্য স্কুলের শিক্ষার্থী ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি ঐচ্ছিক। কাজের অন্তর্ভুক্ত।

খ) উপজেলা পরিষদের কাঠামো: ১৯৮৩ সালে প্রথম উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো উপজেলা পরিষদ। কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে একটি উপজেলা গঠিত হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি নানা কারণে স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। তাই উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ পুনঃপ্রচলন এবং উক্ত আইনের অধিকতর সংশোধনকল্পে ৬ এপ্রিল ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ আইন পাস হয়। এ আইন 'উপজেলা পরিষদ (রহিত আইন পুনঃপ্রচলন ও সংশোধন) আইন ২০০৯' নামে পরিচিত। স্থানীয় জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ গঠনের বিধান রয়েছে। বিধান অনুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হবে:

উপজেলা পরিষদের কাজ- 

• উপজেলা পরিষদ পাঁচসালাসহ বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে; 

• সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধান ও তার সমন্বয় সাধন করে; 

• বিভিন্ন ইউনিয়নের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। বলা বাহুল্য এ সকল কাজের সফলতা নির্ভর করবে উপজেলার জনগণের আন্তরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

গ) জেলা পরিষদ গঠন কাঠামো: কয়েকটি উপজেলা নিয়ে একটি জেলা গঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ৬ জুলাই ২০০০ সালে 'জেলা পরিষদ আইন ২০০০' প্রবর্তন করে। আমাদের দেশে ৬৪টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৬১টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। আইনের বিধান অনুযায়ী বান্দরবান পার্বত্য জেলা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা- এই তিনটি জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যমান আইনে জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ সদস্য এবং পাঁচজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য থাকেন। জেলা পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর।

জেলা পরিষদের কাজ 

জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করাই জেলা পরিষদের কাজ। জেলা পরিষদের কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ১. প্রধান কাজ ২. ঐচ্ছিক কাজ।

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান কাজ হলো-

• জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ তদারকি, 

• উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও ব্যক্তির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা ও সহযোগিতা করা; 

• উপজেলা ও পৌরসভার সংরক্ষিত এলাকার বাইরে রাস্তাঘাট নির্মাণ; 

• সেতু, কালভার্ট নির্মাণ; 

• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন; 

• আবাসিক হোস্টেল নির্মাণ; 

• বেকার জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন; 

• অনাথ আশ্রম নির্মাণ; 

• গ্রন্থাগার তৈরি ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা; 

• কৃষি খামার স্থাপন; 

• বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ এবং পানি সেচের ব্যবস্থা করা; 

• এছাড়া জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের কাজ; 

• উপজেলা ও পৌরসভাগুলোকে সহায়তা, সহযোগিতা ও উৎসাহ প্রদান; 

• বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষণ; 

• যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন; 

• সরকার কর্তৃক আরোপিত অন্যান্য কাজও জেলা পরিষদ করে থাকে।

ঐচ্ছিক কাজ:

• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ মঞ্জুরি প্রদান ও শিক্ষা উন্নয়নের সহায়ক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ; 

• জনসাধারণের জন্য খেলাধুলার আয়োজন ও উন্নয়ন; তথ্যকেন্দ্র স্থাপন: 

• জাতীয় দিবস উদ্যাপন: শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ; 

• গৃহহীনদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা: 

• বিধবা সদন, এতিমখানা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন; 

• সামাজিক অনাচার যেমন: মাদক সেবন, জুয়া, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি প্রতিরোধ; 

• বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ; 

• সালিশী ও আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ; আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন; 

• উন্নত কৃষিপদ্ধতির প্রসার ঘটানো; 

• আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও সংরক্ষণ; উন্নত চাষ পদ্ধতিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ: 

• পতিত জমি চাষে উদ্বুদ্ধকরণ; 

• বাঁধ নির্মাণ ও প্রয়োজনে মেরামতের ব্যবস্থা গ্রহণ: 

• সেচের পানি সরবরাহ, সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ; 

• জেলার বনভূমি সংরক্ষণ; 

• গ্রামাঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলো সচল রাখার জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ ও সরবরাহ করা; 

• গ্রামাঞ্চলের শিল্প-কারখানা চালু রাখার জন্য প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ; 

• উৎপাদিত সামগ্রী বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা; 

• উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাতকরণের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন; শিক্ষাবর্ষ ২০২৪ 

• ধর্মীয় উপসনালয়, যেমন: মসজিদ, মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ও গির্জার উন্নয়ন এবং ধর্মীয় ও নৈতিক। শিক্ষার চর্চার প্রসার ও উন্নতি সাধনের জন্য জেলা পরিষদ কাজ করে।

ঘ) পৌরসভা গঠনঃ শহর এলাকার স্থানীয় সরকার হিসেবে পৌরসভা পরিচিত। বাংলাদেশের প্রতিটি শহর এলাকায় একটি করে পৌরসভা রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে ৩৩০টি পৌরসভা আছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন মেয়র নির্বাচিত হন। প্রতি ওয়ার্ড থেকে একজন করে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলদের নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়। শহর বা পৌর এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পৌরসভার সদস্য সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।

পৌরসভার কাজ

• বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা; 

• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য হোস্টেল নির্মাণ; 

• শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; 

• শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান; 

• বিনামূল্যে বই বিতরণ; 

• বাধ্যতামূলক ও গণশিক্ষার ব্যবস্থাকরণ; 

• স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা; 

• শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; 

• বিধি মোতাবেক ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা; 

• চলাচলের সুবিধার জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাস্তাঘাটের নামকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; 

• দ্রুতগতির যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা; 

• রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগানো, পার্ক উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা; 

• বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপন; 

• ত্রাণ ও পুর্নবাসন; 

• এতিম ও দুস্থদের জন্য এতিমখানা পরিচালনা; 

• লাইব্ররি ও ক্লাব গঠন: 

• ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধ; 

• খেলাধূলার ব্যবস্থা:

• মিলনায়তন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; 

• জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ নিবন্ধন; 

• মহামারি ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ; 

• চিকিৎসা কেন্দ্র গঠন এবং সেবা গ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা; 

• দুর্যোগকালে জনগণকে সচেতন করা ইত্যাদি পৌরসভার কাজ।

 

ঙ) সিটি কর্পোরেশন গঠন: বাংলাদেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন আছে। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ- এই প্রতিটি জেলা শহরে আছে একটি করে সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের প্রধানকে বলা হয় মেয়র। মেয়রের কাজে সহযোগিতা করেন কাউন্সিলররা। সিটি কর্পোরেশনের আয়তনের ভিত্তিতে কাউন্সিলর সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। সিটি কর্পোরেশন যেসব কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে-

• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা; 

• মানসম্মত শিক্ষা সুনিশ্চিত করা; 

• কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা; 

• জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা; 

• বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা; 

• স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা; 

• শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; 

• নিয়মানুযায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা; 

• সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ নিশ্চিত করা; 

• সড়ক নির্মাণ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা;

• রাতের বেলায় সড়কে আলো নিশ্চিত করা; 

• রাস্তার দুই ধারে গাছ লাগানো, পার্ক উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা; 

• ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স সরবরাহ করা; 

• বিশেষ সময়ের বাজার ব্যবস্থাপনা যেমন: ঈদুল আজহার সময় গরুর বাজার ব্যবস্থাপনা; 

• সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা; জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা; 

• খেলাধুলার আয়োজন করা; • সমাজকল্যাণমূলক কাজ; 

• আত্ম-কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, যেমন: সেলাই শেখানো, গাড়ি চালানো শেখানো, ডেন্টিং-পেইন্টিং, ব্লক-বাটিকের কাজ; 

• তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি সিটি কর্পোরেশনের কাজ।

তোমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ বিভিন্ন সংস্থার কাজে মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। অর্থাৎ একই কাজ একাধিক সংস্থা করে থাকে। আবার কাজে ভিন্নতা থাকলেও এর মধ্যেও মিল রয়েছে। সব কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণ ও সমাজর উপকার এবং জীবনমানের উন্নতি সাধন করা।

স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব

৮৫ হাজারেরও অধিক গ্রামের সমন্বয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি গঠিত। সবুজের বুকে লাল টুকটুকে সূর্যে আঁকা আছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মুখচ্ছবি। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার বা ৫৬ হাজার ৯৭৭ বর্গমাইলের আমাদের এই মাতৃভূমি। রাষ্ট্রের আয়তন খুব বড়ো না হলেও জনসংখ্যা বেশি। কেন্দ্রে বসে এত বড়ো দেশের উন্নয়ন পরিচালনা এবং নানা রকম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়। তাই সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য এ ধরনের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ যেমন কমে, তেমনি স্থানীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানও সহজ হয়। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্থানীয় সরকারব্যবস্থা।

 

Content added By
Promotion